আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। স্বল্প শ্রম, স্বল্প পুঁজির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যম হিসেবে মৌ-চাষ অনন্য। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌ-চাষ করে মধু ও মোম ছাড়াও পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের অর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে উপকারের দিক থেকে মৌ-মাছিকে সেরা ধরা হয়। মধু ছাড়াও মোম এবং আঠা সংগ্রহ করা হয় মৌচাক হতে। এছাড়া পরাগায়নে সাহায্য করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও ভুমিকা রাখে মোমাছি। মধু সারা পৃথিবীতে সব থেকে সুস্বাদু ও উত্তম পানিয় হিসেবে বিবেচিত যা রোগ প্রতিরোধেও বড় ভুমিকা রাখে।
একটা সময় ছিলো যখন শুধু সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করা হতো। মৌয়ালরা বাঘের ভয়কে তুচ্ছ করে মধু সংগ্রহ করতেন। তারা আঞ্চলিকভাবে মধু সংগ্রহ করত যার ফলে অনেক মৌমাছি ধ্বংস হয়ে যেত।
বর্তমানে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতিতে অনেক কিছু সহজ সাধ্য হয়েছে।পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখন কাঠের বাক্সে কৃত্রিম বাসায় মৌমাছি চাষ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কলোনি সংগ্রহ করে কৃত্রিম ভাবে রানি উৎপাদন করে কাঠের বাক্সে মোমাছি চাষ করা হচ্ছে।
ধারনা করা হয় ত্রিশের দশকে মহত্মা গান্ধী পরিচালিত
' স্বয়ম্ভরতা ' আন্দোলনের সময় থেকে কাঠের বাক্সে মোমাছি পালন শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে সরকারের গৃহিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-চাষ ব্যার্থ হয়। সত্তরের দশকে কিছু লোক ও সংগঠন এর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলে BSCIC ও বেসরকারি সংগঠন প্রশিকা উদ্যোগী হয়।১৯৭৭ সালে কানাডার একটি সংস্থা (Canadian Voluntary Organization CUSO of the CIDA ) মৌ-চাষে আর্থিক সহায়তা করে। প্রশিক্ষন ও সমপ্রসারন কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-চাষ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব বলে পরিলক্ষিত হয় বিধায় ১৯৮১ সালে Bangladesh Institute of Apiculture প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিপালন এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কারিগরি জ্ঞান, যন্ত্রপাতি, ফুলের পর্যাপ্ততা ও সর্বসাধারণের উৎসাহ সবই বাংলাদেশে মৌমাছি পালনের অনুকূল। ইতোমধ্যে কিছু বেসরকারি সংস্থা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৫টি গবেষণা ও প্রদর্শনী কেন্দ্রের মাধ্যমে মৌমাছিপালন কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছে।
প্রশিক্ষণ, সম্প্রসারণ, কিছু প্রায়োগিক গবেষণা ও বিপণনের মাধ্যমে বাংলাদেশ মৌমাছিপালন ইনস্টিটিউট মৌমাছিপালন প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য সফলতা লাভ করেছে। এ ইনস্টিটিউট থেকে মৌমাছি পালনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মৌমাছিপালক সমিতিগুলি গ্রামের লোকজনদের মৌমাছি পালনে উদ্বুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ মৌমাছিপালন ইনস্টিটিউট প্রায়ই নামমাত্র মূল্যে কৃত্রিম কাঠের মৌচাক সরবরাহ করে। মৌমাছিপালন, বিশেষত গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের আয়ের একটি উত্তম উৎস হিসেবে গণ্য হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে মৌমাছির সহায়ক পর্যাপ্ত গাছপালা, সবজিবাগান ও সরষে ক্ষেত আছে। যার কারণে গ্রামে মধু উৎপাদন সহজ।
বাংলাদেশে মৌমাছির প্রধানত তিনটি প্রজাতি আছে, যথা: Apis indica, A. dorsata এবং A. florea। বেশ কিছুদিন আগে ইউরোপ থেকে Apis mellifera নামক একটি প্রজাতি বাংলাদেশে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য A. indica বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং কাঠের বাক্সে অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে এদেরকে প্রতিপালন করা যায়। A. dorsata বন্য প্রকৃতির, জঙ্গল কিংবা বাড়ির চারদিকের বড় বড় গাছে এদের চাক দেখতে পাওয়া যায়, এমনকি ঘরের কার্নিসেও এরা বাসা বাঁধে। পেশাদার মধু সংগ্রহকারী A. dorsata-র কলোনিকে মধুর উৎস হিসেবে বেছে নিয়ে মধু সংগ্রহ করে। সে কারণে কোন কোন সময় এসব মৌচাক এবং মৌমাছির ক্ষতি সাধিত হয়। মধু সংগ্রহের এ ধরনের প্রাচীন পদ্ধতি বাংলাদেশে মৌমাছির সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ।
মোমাছি পালন প্রকল্প স্থাপনের জন্য আলাদাভাবে কোন জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আনাচে-কানাচে, ঘরের বারান্দায়, ছাদে কিংবা বাগানেও মৌ-বাক্স রাখা যায়। অ্যাপিস সেরানা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সম্বলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট বিনিয়োগ ১৫-১৬ হাজার টাকা। প্রতিবছর গড়ে প্রতি বাক্স থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যাবে,যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা হিসেবে ২৫০০ টাকা। এ হিসেবে ৫ টি বাক্স থেকে উৎপাদিত মধুর মূল্য দাঁড়াবে ৫-১০কেজি ২৫০ টাকা(প্রতি কেজি) =১২,৫০০ টাকা।এই আয় ১০-১৫ বছর অব্যাহত থাকবে অর্থাৎ প্রথমে মাত্র একবার ১৫-১৬ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রকল্প স্থাপন করলে মৌ-বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। আর কোন বিনিয়োগ বা খরচ নেই বললেই চলে।অন্যদিকে অ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সম্বনিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট ব্যয় হবে ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা।এক্ষেত্রেও ১০-১৫ বছর পর্যন্ত মৌ-বাক্স ও অন্যান্য যন্তপাতি এবং সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা যাবে। আর কোন অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। মেলাফিরা প্রজাতির প্রতিটি মৌ-বাক্স হতে বছরে ৫০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব,যার বাজার মূল্য ৫০ কেজি ২৫০ টাকা(প্রতি কেজি)৫টি বাক্স = ৬২,৫০০ টাকা।প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মাত্র ২৫-২৭ হাজার টাকা এককালিন বিমিয়োগ করে প্রতিবছর ৬০ হাজার টাকার উর্ধে আয় করা সম্ভব।মৌ-বাক্সের সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধির মাধ্যমে এ আয় অনেক গুন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
নব্বইয়ের দশকে ভারতে মধু রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশ। সেটাই শুরু। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাজারেও মধু যেত। এখন বিশ্বের অন্যতম বড় ও সংবেদনশীল মধুর বাজার জাপানে রপ্তানি শুরু হয়েছে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মধু বিশ্বমানের।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বাজারে মধু রপ্তানি প্রক্রিয়াধীন আছে। স্লোভেনিয়া বাংলাদেশ থেকে মধু আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে প্রবেশের প্রক্রিয়াও চলছে।
মধুর রপ্তানি বাড়ার প্রধান কারণ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ভেতর মধু উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিসিকের উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে দেশে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে বাক্সভিত্তিক মধুর বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১২ সালেও দেশে মধু উৎপাদন হতো প্রায় দেড় হাজার টন। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৬ মধু উৎপাদন হয়েছে চার হাজার টন। এখন তা পাঁচ হাজার টন এর কাছাকাছি।
আগে ভারতের ডাবুরসহ কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশের মধু কিনে নিয়ে যেত কাঁচামাল হিসেবে। তবে গত কয়েক বছরে এপি, প্রশিকা, বাসা, ট্রপিকা হানি, প্রাণসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি মধু প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা স্থাপন করেছে। এই কোম্পানির ব্র্যান্ড দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি দেশের বাইরে পা রাখতে শুরু করেছে।
দেশে যে চার হাজার টন মধু উৎপাদিত হয়, তার ৭০ শতাংশ আসে সরিষা থেকে, ১০ শতাংশ লিচুবাগান এবং বাকি মধু অন্যান্য উৎস থেকে। দেশে ব্যাপক হারে বাণিজ্যিক মধুর চাষ শুরু হয় ২০১২ সাল থেকে।
মধুর চাষ পরিবেশ ও কৃষির জন্যও উপকারী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গবেষণা জানাচ্ছে, মধুর চাষ হয় এমন এলাকায় ফসলের উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ফসল চাষে মৌমাছির ভূমিকা নিয়ে করা এফএওর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মধু আহরণ করতে আসা মৌমাছির কারণে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের জমিতে চাষ হওয়া ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। মৌমাছি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ফসলের পরাগায়ন ঘটায়, ফলে উৎপাদন বাড়ে। বিশেষ করে ফলের উৎপাদন এ ক্ষেত্রে বেশি বাড়ে।
সরিষাখেতের পাশে মধু সংগ্রহের জন্য মৌমাছি পালন করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ সালে দেশে ৫ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৬ লাখ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে দেশে সরিষা উৎপাদন ৭ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। মূলত মধু চাষের উদ্দেশ্যেই সরিষার চাষ করা হলেও সরিষা থেকে উৎপাদিত হয় সরিষার তেল। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসা সরিষার তেলও ভোজ্যতেলের বাজারে আবার ফিরে আসছে নতুন রূপে।
মধু চাষের পথ বেয়ে লিচু উৎপাদনেও বিপ্লব ঘটেছে দেশে। ২০১১ সালে যেখানে ১৮ হাজার ২৪৬ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ২০ হাজার টন লিচু হয়েছে, সেখানে ২০১৬ সালে তা বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ টন ছুঁয়েছে। অন্যতম পুষ্টিকর এই ফল উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ভালো মানের রানি মৌমাছি, পরিবহন, সংরখন ইত্যাদি সমস্যা এ খাতে বড় বাধা।
পরিশেষে বলা যায় গ্রামিন অর্থনীতির উন্নয়নে মধু উৎপাদন হতে পারে একটি নিয়ামক। কিন্তু তার জন্য উদ্যোগতাদের আরও বেশি সাহায্য করতে হবে এবং বাজার সম্প্রসারণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসূত্র :
- উইকিপিডিয়া
- প্রথম আলো
- BSCIC
লেখক :
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি বিভাগ,
ঢাকা স্কুল অব ইকনমিক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments
Post a Comment