Skip to main content

পর্যটন শিল্পে করোনা ভাইরাসের প্রভাব || Econometry

পর্যটন হল এক ধরনের বিনোদন, অবসর অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করাকে বুঝায়। 

ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।



বাংলাদেশে পরিচিত-অপরিচিত অনেক পর্যটন-আকর্ষণীয় স্থান আছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। 

এর মধ্যে প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মিনার, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্য ইত্যাদি অন্যতম। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি এলাকা বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত । 

   এছাড়াও অন্যান্য পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে, 

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা, চাঁদপুর মিনি কক্সবাজার, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোমপুর বৌদ্ধবিহার, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, 
মহাস্থানগড় এবং সিলেটের জাফলং উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। ধারণা করা হয়েছিল ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করত এশিয়ার দেশগুলোতে।
 
২০১৮ সালে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (সূত্র: WTTC)। 

বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের মধ্যে অন্যতম। 
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (WTTC) এক গবেষণা অনুযায়ী, 

২০১৪ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ
২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। 
সে হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। 

পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরে যেমন-
পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। ইতিমধ্যে পর্যটনকে বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

কিন্ত,চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাস প্রথম সংক্রমণের মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে এটি বৈশ্বিক সবোর্চ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়। আর ৪৫ দিনের মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি আকার ধারণ করে ভাইরাসটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে অতি মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। মন্দা দেখা দিয়েছে পর্যটন খাতেও। 

ট্যুরিজম ইকোনমিকস সূত্র অনুযায়ী, হোটেল, রেস্তোরাঁ, থিমপার্ক এবং ভ্রমণ ব্যয়ের অন্যান্য বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছর প্রায় ২৫৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মখীন। 

২০০৩ সালে সার্স প্রাদুর্ভাবের সময় এই শিল্পে যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে

বিশ্ব ট্যুরিজম ইকোনোমিক্স ধারণা করছে,
         ২০২০ সালে ভ্রমণ হ্রাস পাবে ৯.১ শতাংশ যা বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সবোর্চ্চ। 
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস যা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত, এর প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে বিধিনিষেধ, আন্তর্জাতিক সম্মেলন বাতিল, ক্রিকেট প্রিমিয়ার লীগ ও ফুটবল প্রিমিয়ার লীগ বাতিল করা হয়েছে। যার  ফলে হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে রুম বুকিং বাতিল হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশও করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। এরমধ্যে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দীর্ঘ এক মাস ধরে জনশূন্য। আগে বাংলা নববর্ষ বরণে নানা অনুষ্ঠান ও লাখো পর্যটকের সমাগমে সমুদ্র-শহর কক্সবাজার থাকতো মুখর। অথচ আজ শুনসান নীরবতা সমুদ্র-শহরের কলাতলী, হিমছড়ি ও ইনানী বিচজুড়ে। কোন দোকানপাট খোলা নেই, রাস্তায় নেই কোন কোলাহল। সবকিছুই এখন করোনার দখলে; ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে পর্যটন শিল্প। বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ।
বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়কভিত্তিক বেসরকারি ডেটা ম্যানেজমেন্ট বা উপাত্ত  ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নোয়েমার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিলক্ষিত হয়, 

বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন পর্যটকে কর্মসংস্থান হয় ৯৪৪ জনের। ২০১৭ সালে এ দেশে মোট ১০ লাখ ২৬ হাজার পর্যটক এসেছে। এখানকার পর্যটন খাতের আকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। ভারতে ২০১৭ সালে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার পর্যটক গেছেন। দেশটির পর্যটন খাতের আকার জিডিপির ৯ দশমিক ২ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে প্রতি ১০০ পর্যটক আসার কারণে কর্মসংস্থান হয় ৮৩ জনের, ২০১৭ সালে দেশটিতে ৬৬ লাখ ২১ হাজার পর্যটক এসেছিলেন যা জিডিপির ২৪.৭ শতাংশ। করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ফলে পর্যটক কমে যাওয়ায় বিশ্বে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়ে গেছে।
 
     আর এ কথাও বাঞ্ছনীয় যে, করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত হলেও খুব দ্রুতই এই খাতে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। কারণ, এই অর্থনৈতিক ধাক্কার পর সর্ব সাধারনের মাঝে ভ্রমণ বাবদ খরচ করার মত পর্যাপ্ত টাকা থাকবে না এবং এমন কি ইচ্ছাও না থাকতে পারে যা এইখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি মানুষদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এমতাবস্থায়, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে নিম্ন লিখিত সুপারিশগুলো গ্রহণ করা যেতে পারেঃ-

১. সরকারের পক্ষ থেকে এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি মানুসদের আপদকালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। 

. করোনা পরবর্তী  কিছু বছরের জন্য(অন্তত ৩ বছর) সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ঋণের দ্রুত ব্যবস্থা করা।

৩. আগামী বাজেটে  পর্যটন খাতের সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকার কর্তৃক যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা।

৪. কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, সিলেট, বরিশাল ও অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটন-সংশ্লিষ্ট স্বল্প আয়ের পেশাজীবীদের (স্থানীয় ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, কমিউনিটি পর্যটন পরিবার, মাঝি, চালক ইত্যাদি) জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে আপদকালীন আর্থিক অনুদান নিশ্চিত করা।

৫. আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রচার, ব্র্যান্ডি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে বিশেষ তহবিল গঠন করা যেতে পারে।
করো্না পরবর্তী অল্প সময়ে বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা।


লেখক :

                        ফরহাদ এইচ মজুমদার
                        উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগ,
         ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।










Comments

  1. পর্যটন খাতটি অামাদের দেশের একটি উল্লেখযোগ্য খাত।এই খাতটি নিয়ে সুন্দর এই রিপোর্ট ও প্রস্তাবনাটি বাস্তবেই যুগোপযোগী। লেখককে অামার পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন রইল.👍👍👍

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপকূলীয় অঞ্চলে শরণার্থী হতে পারে ৩০ মিলিয়ন মানুষ।

বাংলাদেশ প্রায়শই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, টর্নেডো ইত্যাদি আঘাত হানে।এর মধ্যে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং এর সাথে যুক্ত ঝড়ের তীব্রতা সবচেয়ে বিপর্যয়কর। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও ঝড়ের তীব্র বিপর্যয়ের প্রভাবের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এই বিপর্যয়কর প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ফলস্বরূপ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার ন্যায়।গত 110 বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের দ্বারা প্রভাবিত জলবায়ু এবং ঘূর্ণিঝড়ের ফ্রিকোয়েন্সি, তীব্রতার প্রবণতা পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা 2 ° C থেকে 4 ° C এবং সমুদ্র স্তর 0.3 মিটার থেকে 1.0 মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। Source:Carbon Brief বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন একটি চূড়ান্ত বিষয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ সারা বছর মোটামুটি প্রত্যক্ষ রেডিয়েশন গ্রহণ করে এবং তুলনামূলকভাবে উচ্চ তাপমাত্রা বজায় রাখে। এবার যদি আমরা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনীতির...

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিকভাবে আমের ভূমিকা

আম আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধির এক বিরাট সুযোগ হতে পারে। একটি উৎকৃষ্ট সুস্বাদু ফল হিসেবে আমের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অপরিসীম। সারা দেশে আম উৎপন্ন হয় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার একর জমিতে। সুতরাং এত বিপুল পরিমাণ জমিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনশক্তি সম্পৃক্ত থাকে। বাগান চাষ ও পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ছাড়াও শুধু ফলনের মৌসুমেই অর্থাৎ বছরের প্রায় ৪/৫ মাস প্রচুর লোক সারা দেশে আম সংক্রান্ত কর্মকাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে।   নিম্নোক্তভাবে এক্ষেত্রে জনশক্তির কর্মসংস্থান হতে পারেঃ ১. আম চাষ ও পরিচর্যার মাধ্যমে ২. সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ৩. আম ও আমজাত দ্রব্যাদি পরিবহনের মাধ্যমে ৪. আম ও আমজাত দ্রব্যাদি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ৫. আম শিল্প ১) আম চাষ ও পরিচর্যার মাধ্যমেঃ ভালো ফলনের জন্য আম গাছে পরিকল্পনা- মাফিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। আমের মুকুল আসা থেকে শুরু করে পূর্ণতা অর্থাৎ আম গাছের সঠিক পরিচর্যা ঠিকমতো না হলে ফলনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর কমপক্ষে ৪/৫ মাস আম বাগান পরিচর্যার জন্য প্রতি তিন একর আয়তন বিশিষ্ট আম বাগানে ৫ জন শ্রমিক কর্মরত থাকেন। ...